অন্তরীণ
-কাজল দাস
পারমিতা- বাব্বা যা ট্রাফিক জ্যাম, একটু দেরি হয়ে গেল, তুমি কতক্ষণ?
কবীর- থাক সেই কথা জেনে লাভ নেই, সেই একই প্রশ্ন বত্রিশ বছর ধরে শুনে
আসছি, এখন কলপেও সফেদি আর ঢাকে না।
পা- এই রাগ করোনা প্লীজ, চলনা ঐ দিকটা গিয়ে বসি, এই দিকটা খুব সোরগোল, চলো চলো।
ক- কোথায় সোরগোল? আসলে বলো হাঁটুর বয়সী ছেলে মেয়েদের সামনে বসে প্রেম করতে লজ্জা করে।
পা- দেখ’ কবীর এমন ভাবে কথা বললে আমি কিন্তু চলে যাব, হ্যাঁ লজ্জা করে, এখানে সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কি জানি কি ভাবে। তোমার করে না?
ক- লজ্জা করলে কি করবো, দেখা করা কি ছেড়ে দেব?
পা- তাই তো- তোমার তো আর কিছুই করার নেই! কেন আমরা বিয়ে করে নিতে পারিনা!
ক- হা হা হা, এই বয়সে বিয়ে? তা মন্দ বলনি, এটাই বাকি ছিল, নাইস জোকস্।
পা- কেন? এখন তো আমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই, আপত্তি জানানোরও কেউই নেই, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধে কোথায়?
ক- কেন গো, তোমার আর আমার বাবা মায়ের সাথে আত্মীয় স্বজন সকলের জানাজাও উঠে গেছে নাকি?
পা- চলো না কবীর এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাই, যেখানে আমি আর তুমি ছাড়া আর কেউই থাকবে না, এই শহর থেকে অনেক দূর!
আমাদের একটা আলাদা ঠিকানা। সেখানে আমি সারাদিন তোমার অপেক্ষা করবো, তারপর তুমি কাজ থেকে ফিরে এলে, দুজনে মিলে ব্যালকনিতে বসে চা খাব, গল্প করবো। আমাদের একটা নিজেদের সংসার, চলনা কবীর!
ক- (একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে)- এখন আর তা হয় না পারমিতা, দ্যাখ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়া কি ঠিক হবে!
পা- কেন হবেনা, এভাবে আর কতদিন বল’তো? আমার আর ভালো লাগে না, কত স্বপ্ন কত আশা নিয়ে একদিন তোমার হাত ধরে ছিলাম। এখনও অনেক খানি পথ পড়ে আছে, চলো না কবীর নতুন ভাবে জীবনটা শুরু করি।
তখনও তোমাকে বলেছিলাম চল আমরা পালিয়ে যাই, তুমি কি বললে- না পালিয়ে বিয়ে করবে না। সেদিন যদি সঠিক সিদ্ধান্ত টা নিতে পারতাম, আজ তবে-
ক- তুমি তো জানো, সেদিন আমি নিরুপায় ছিলাম, ভেবেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা একদিন তোমার বাড়ির লোক মেনে নেবে, আমার আব্বু আম্মুর দিক থেকে তো কোনো সমস্যা ছিল না। তারা তোমাকে পছন্দই করতো।
পা- আমি তো বলেছিলাম তোমায়, আমাদের সম্পর্কটা কোনো দিনই আমার বাবা মেনে নেবে না। কারণ-
ক- এই শোনো না, একটু চা খাবে?
পা- কথা ঘোরানোর চেষ্টা করো না, আমি বুঝতে পারছি এসব কথা তোমার ভালো লাগছে না।
ক- এই শোনো না, রাগ করোনা প্লীজ, আমার জন্য কি এনেছো? দাও দাও খুব খিদে পেয়েছে।
সিমুই? বাঃ
এই তোমার মনে আছে কলেজের সেই দিনটার কথা, একদিন হঠাৎ করে তুমি টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি সিমুই হাতে দিয়ে বললে- শুভ জন্মদিন।
আমি তো অবাক,
-আমার জন্মদিন আমি জানি না, তার চেয়ে বড় কথা আমার আম্মুও জানেনা, আর তুমি জানলে কি করে?
উত্তরে তুমি কি বলেছিলে মনে আছে?
পা- আছে,(গম্ভীর হয়ে)- আমি বলেছিলাম- আজ থেকে এই দিনটাই তোমার জন্মদিন।
ক- কি অদ্ভুত দেখ আমিও,- এই দাঁড়াও দাঁড়াও আজ কত তারিখ?
পা- কেন? তোমার জানা নেই।
ক- তাই বলি হঠাৎ সিমুই। আর কিছু দেবে না? কি গো দেবে না? এই দাওনা-
পা- থাক আর নাটক করতে হবে না। অনেক হয়েছে। সেই ফুটপাত, নয়তো চায়ের দোকান, এভাবে ত্রিশ বত্রিশটা বছর কাটিয়েই দিলে, আর তো কয়েক টা বছর, তার পর তুমি কবরে আমি আগুনের হাত ধরে মহাকাশে পাড়ি দেব।
ক- দ্যাখো, এসব কথা একদম বলবে না। আর আমাদের বয়সই বা কি? আমরা হলো গিয়ে চির নবীন প্রেমিক। -“এয় মেরে জোহরাজবি তুঝে মালুম নেহি তু অভিতক হাসিন অর ম্যায় জবা, তুজপে কুরবান মেরি জান মেরি জা।”
পা- থাক থাক হয়েছে, অনেক দেরি হয়ে গেল। এবার উঠতে হবে, এভাবে দেখা করতে আর ভালো লাগে না। এই নাও-
ক- এটা আবার কি?
পা- কলম, যা আমার চেয়েও তোমার কাছে বেশি প্রিয়, আমি জানি আমাকে ছাড়া দিব্যি ভালোই থাকতে পারো, তোমার কবিতাকে নিয়ে। তাই তোমার ভালো থাকার উপকরণ-
ক- খুব সুন্দর, সারারাত এই কলমটাই আমার দোসর হবে। তোমার অভাব পূরণ করতে এর চেয়ে ভালো বন্ধু আর হয় না। কাল কখন আসবে?
পা- বলতে পারব না। আর যদি না আসি, যদি আর দেখা না হয়?
ক- অপেক্ষায় থাকবো, এই খানেই এই সময়। আর একটু থেকে গেলে হয় না। আজ তোমায় যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না।
পা- না, আর থাকা যাবে না, রাত হয়ে গেছে, আমি আসি হাত ছাড়ো।
ক- কাল ঠিক আসবে তো?
আমরা যখন প্রেমে পড়বো-
বয়স টয়স মানবো না আর, জাত-পাতও বাছবো না আর
তোমায় দেখেই প্রেমে পড়বো,
দুই বাড়িতেই অসম্মতি, থমকে সময়?
মানবোনা আর, দিব্যি দেবে, দিগ্গে যা
আমরা কিন্তু প্রেমে পড়ব’ই।
ছুট লাগাব তেপান্তরে, ছুটতে ছুটতে বেসামালই
নষ্ট হব, বেজাত হব,
আমরা কিন্তু থামবনা আর-
নদীর মত ছুট লাগাবো
হাতের কাছে জীবন খুঁজে-
দু’হাত দিয়ে রঙ মাখাব,
ছুটতে ছুটতে আবীর হয়ে-
তোমার বুকে ঘর বাঁধব,
তোমার চোখে, তোমার মুখে তোমার ঠোঁটে ঘর বাঁধবো।
আমরা কিন্তু প্রেমে পড়ব’ই।
শুধরে নেওয়া জীবনটাকে
সাজিয়ে তেমন রাখবনা আর, তুমি আসবে
সঙ্গে যদি উস্কোখুস্কো সময় আসে?
তাকেই নেব আপন করে,
তোমার হাতে ঘন্টা খানেক ঠোঁট রাখবো,
তুমি কি খুব লজ্জা পাবে?
তুমিও হবে মুক্ত আকাশ, আমি হব প্রথম পুরুষ
মেঘের মতই উড়নচণ্ডী।
সময় যদি পাই বা না পাই
আমরা কিন্তু প্রেমে পড়ব’ই
একটু তোমায় ছুঁয়ে দেখবো,
না না একটুতে নয়, চোখ যেখানে পায়নে নাগাল-
তোমায় আমি দেখবো ছুঁয়ে।
ঝড় ওঠা কোনো সন্ধ্যে বেলায়
যখন আকাশ ক্লান্ত হবে-
একটুখানি কাছে যাব,
তুমিও খানিক আসবে কাছে,
সেই সুবাদে ধূলোর রাশি মাখবে তোমার চোখের ভাষা।
আমিও খানিক দেখবো চেয়ে তুমি কেমন বইতে পার,
না না একটুতে নয় আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে ধরার ইচ্ছেটাকে রাখবো ধরে সঙ্গোপনে।
আমরা তখন বৃষ্টি হওয়ার অপেক্ষাতে
ফুলের গন্ধ মাখব গায়ে,
প্রেমে পড়বো।
তোমায় নিয়ে, হ্যাঁ হ্যাঁ তোমায় নিয়ে
পাহাড় চূড়ায় ঘর বাঁধবো, ছনের চালা,
মাটিতে তার মাদুর পেতে বসবো দুজন
পিঠের সাথে পিঠ ঘেষিয়ে নানান সুরে গান গাইবো,
যে গান তোমার ভালো লাগে, সেই গানটাই গাইবো না হয়।
দু এক ফোঁটা শিশির মেখে আসবে আমার পরম চাওয়া,
হাওয়ার সাথে মিশিয়ে তাকে-
তোমার চুলে, তোমার ঠোঁটে তোমার গলায় মাখিয়ে দেব।
একটা ঘরে দুজন মিলে কাটিয়ে দেব
এ জীবনটা।
আবার যদি প্রেমে পড়ি!
এবার কিন্তু আমি নারী, তুমি হবে প্রথম পুরুষ
প্রথম তোমার দেখার দিনে,
আমি হব লাজুক মেয়ে, তুমি হবে
আমার মতই এখন যেমন উড়নচণ্ডী
নির্লজ্জ বেহায়া বড়, তাই হবে, তাইই হবে।
এবার আমি নারীই হব,
বুকের ভেতর তোমায় পাবার ইচ্ছেটাকে-
সামলে নেব, নারী হলেও ক্ষতি তো নেই,
আবার দুজন প্রেমে পড়বো।
আমি হব নরম নদী তুমি হবে মেঘলা আকাশ,
শুকিয়ে যাওয়া ইচ্ছেটাকে এক নিমিষে-
ভিজিয়ে দিয়ে বলবে- আমি এই এসেছি, বৃষ্টি হয়ে, দুকূল ছেপে।
তখন আমি তোমার কাছেই পরাজিত,
তোমার কাছেই দেব ধরা,
তুমি হবে প্রথম পুরুষ, তুমিই আমার বৃষ্টি মনে একপশলা।
অনেক খানি সময় গেল
এ জীবনটাও অপেক্ষাতে
এবার যদি প্রেমে, পড়ি না- পড়বই
তোমায় নিয়ে ভাববো না আর
তুমি নারী আমি পুরুষ, তুমি পুরুষ আমি নারী
সেসব কথা ভাববনা আর।
ভাবনা মিছেই, কি হব তা সময় হলেই দেখা যাবে,
এ জীবনটা যেমন তেমন কেটে গেল-
কেটেই গেল অপেক্ষাতে।
এবার যদি……..
না না ভাববো না আর-
শুধুই,- শুধুই তোমায় বাসবো ভালো,
ভালো বাসবো, ভালো বাসবো
এবার যদি…………